শনিবার, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৪

নীলার শেষ পরশ

রাত ৩ টার মতো....
এই সময় হিমু এসে ডাকাডাকি শুরু করলো,,

কবি..! এই কবি....!!
ওঠ, ওঠ না....!!
দেখ বৃষ্টি হচ্ছে....!!
তুই না বৃষ্টি ভালোবাসিস....!!

এই ওঠ....!

কবি : ধূর, কয়টা বাজে এখন...?
হিমু : তিনটা বাজে, তুই ওঠ না....!

: নাহ, তুই যা তো... কাল ভোরে আমার ক্লাস আছে,
ক্লাসে না গেলে স্যার কি বলবে জানিস না....?
: জানি, কিন্তু তোকে উঠতেই হবে,, তোর হাতে যে বেশী সময় নেই !!

: প্লিজ, যা না এখন....!! আজ সারা সন্ধ্যা তোর ওই
বইটা পড়লাম, কি যেন নাম....?
: ও হ্যা, সেই বইটা, "তোমাদের এই নগরে"

: হ্যা ওই বইটাই,,, তারপর ২ টা পর্যন্ত ফেইসবুক...!
একটা ঘন্টা ঘুমায়ে পারলাম না, আর তুই
আইসা ডাকাডাকি শুরু করছিস....? প্লিজ, একটু
ঘুমাইতে দে, সোনা ভাই আমার, লক্ষী ভাই আমার,,,,
: না, না, কোন কথায় কাজ হবে না,,, উঠতে তোকে হবেই,

: ভোরে না উঠতে পারলে আম্মু
কি বলবে জানা আছে তো তোর,, বলবে, গার্লফ্রেন্ডের
সাথে সারা রাত মোবাইলে কথা বলছিস....?
ছেলে না এইটুকু, এখনি প্রেম শুরু কইরা দিছে.....!! সকাল সকাল এমন কথা শুনতে কার ভালো লাগে বল তো.....!!
: জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না,
আমি জানি উঠতে তোকে হবেই.....!! আর সেটা তোর ই জন্যে,,,
ওঠ, ওঠ না.....!!!!! দেখ না কি সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে....!

: না, উঠবো না....
: মানি না, মানবো না,,
আমি একা জেগে বৃষ্টি দেখব আর তুই ঘুমাবি...!
তা হবে না, তা হবে না....!!

: ঊফ....! থাম তো...! এত রাতে এই বিদ্রোহ শুধু আমার ঘুম ভাঙ্গাতেই কাজে লাগবে, এছাড়া আর কিছুতেই কাজে লাগবে না,,,,,

: জানি না, ঘুম থেকে তো তোর উঠতেই হবে.....
এই বলে হিমু ঘরের জানালা খুলে দিলো,,
এক পশলা বৃষ্টির জলের
কয়েকটা টুকরো এসে আছড়ে পড়লো কবি র গায়ে,,


না পেরে উঠে বসলো কবি,,
বরাবরের মত ঘুম ভাঙ্গিয়ে হিমু গায়েব,,
কেউ কখনো বিশ্বাস করে নি হিমুর এই ব্যাপার টা,
ও যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে তখন হিমু আসে,,
ওর সাথে কথা বলে,,
যা বলে তাই ই সত্যি হয়,,,,
প্রায় বছর খানিকটা ধরে হিমুর সাথে পরিচয়,,
আজ হিমু জানালা পর্যন্ত খুলে দিল......!!
কে বিশ্বাস করবে এমনটা......!!
নিজেকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে....!!

অস্থির সুন্দর এক পরিবেশের মধ্যে আবিষ্কার করল
কবি নিজেকে । ঘরের লাইট বন্ধ,, হিমুর
খুলে রেখে যাওয়া জানালা থেকে রাস্তার সরকারি আলোর কিছুটা প্রবেশ করেছে,,
এক আলো ছায়ার খেলা চলছে যেন,,

দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো কবি,,

চারিদিক অসম্ভব সুন্দর বরষার মায়াবী শব্দে আচ্ছন্ন,
কেমন যেন মায়া লেগে আছে রুমের মধ্যে...!!
মাঝে মাঝে বৃষ্টিছটা এসে পাগল করে দিচ্ছে,,,
হিমু ঠিক জানতো যে আমি এমনই....!!
প্রকৃতিতে হারিয়ে যেতে ভালোবাসি,,
প্রকৃতির প্রতিটা ভাজে যেন নীলার ছোঁয়া লেগে আছে,
আর বৃষ্টি টা যেন ওর রূপ.....!!


জানালার পাশে গিয়ে দাড়ালো কবি,,
দু হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পরশ নিচ্ছে,,,,
বৃষ্টি হলে পাগলের মত হয়ে যায় কবি,,
একা একা বৃষ্টির মাঝে হারিয়ে যেতে চায়,,
কিন্তু কেউ না কেউ এসে বিরক্ত করবেই....!!
কিন্তু আজ যেন সৃষ্টিকর্তা ওকে ওর শেষ ইচ্ছে পূরণ
করার সুযোগ দিয়েছেন,,
আজ যেন প্রকৃতি ওকে চায়, একাকী ভাবে...!!
এই নিশ্চুপ রাতের মাঝে মায়াবী রূপের অবিরাম বর্ষন,,
হঠাৎ করে ওদের ধাপে ধাপে ভিজিয়ে আপন করে নেয়া,,
সরকারি আলো আর বিজলীর চমকে সৃষ্টি এক
আলো ছায়ার খেলা.....!!
এ সব যেন আজ ওর একার জন্যেই.....!!
সৃষ্টিকর্তা আজ তার অস্তিত্বের পুরোটা প্রমান
দিলেন...!!

বারবার কবি হারিয়ে যাচ্ছে নীলার মাঝে,,
কেমন যেন মাথাটা অকেজো হয়ে যেতে চাইছে,,
শীতলের সেই স্মৃতি গুলো নিজের অজান্তেই
হাতড়ে চলেছে.....
কতটা ভালোবাসে ও নীলাকে.....!!
জানে নাহ,,
বলা যায় না এভাবে....!!!

চেয়ার টা টেনে নিয়ে বসে,,
হাতে ডায়েরি টা নেয় কবি,,,,
দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকায়,,
সময়টা একবার দেখে নেবার জন্যে,
ঘড়িটা অন্ধকারে টিকটিকি করে চলেছে....!!

বালিশের নিচে হাত দিতেই ব্লেড আর মোবাইল
টা হাতে আসে কবি র....
অনেক দিন শেভ করা হয় না,,,
অনেকে তো রিতিমত দেবদাস বলে ডাকাডাকি শুরু
করে দিয়েছে,,
বালিশের নিচ থেকে ব্লেড আর মোবাইল দুটোই হাতে এল ওর,,
মোবাইলের লক বাটন চাপতেই নীলার অপলক
চাউনি টা ভেসে উঠলো,,
কয়েক টা মুহূর্ত যেন কোথায় হারিয়ে গেল...
বৃষ্টির ছটায় সম্ভিত ফিরে পেলো ও,,


সময়টা ৩ টা বেজে ৩৯ মিনিট,,
নাহ,, কিছু মাথায় ঢুকছে না,,,,,,,
নীলার স্মৃতি গুলো যেন টেনে ধরছে ওকে....!!

প্রায় চার চার টা বছর ধরে কেবল মনে মনে জল রঙ
দিয়ে নিখুঁত ভাবে শীতলের ছবি একে চলেছে কবি,,
কিছু মায়া, কিছু কান্না, কিছু ভালোবাসার রঙ মিশিয়ে,,
নীলাকে না পাওয়াটাই যেন ওর জীবন.....!!
কি এক অদ্ভুত কষ্ট,,
পাগলের মত হয়ে যায় মাঝে মাঝে,,
একা একা কথা বলে,,
হাসে,,
কাদে,,
এক অজানা রহস্যের মাঝে ডুবে থাকে,,,,,

ও জানে যে নীলা ওর জন্যে নয়,,
আর কারো জন্যেই নীলার সৃষ্টি,,
তবে ও এটাও জানে যে ওর সৃষ্টি শুধু
নীলাকে ভালোবাসার জন্যে......!!!
এক অব্যক্ত ভালোবাসাই যেন ওর আসল পরিচয়....!!!
স্মৃতিচারণ করতে করতে ক্লান্তির
দেশে হারিয়ে যাচ্ছে কবি,,
দু চোখ বেয়ে অশ্রুরেখার সৃষ্টি হয়ে চলেছে....!!

চোখের জলের বিশেষত্ব টা যেন আজ কঠোর
হয়ে ধরা দিচ্ছে,,,
বৃষ্টির জলের মাঝেও নীলার বিরহে আর রিক্তের
বেদনে পুড়ে গিয়ে অসহ্য যন্ত্রণার অশ্রুধারা যেন খুব
সহজে আলাদা করতে চাইলেই আলাদা করা যায় আবার হারিয়ে ফেলতে চাইলে মুহূর্তের মধ্যেই হারিয়ে ফেলা যায়.....!!!
সত্যিই কি এক রহস্য.....!!!

ডায়েরিতে নিজের অজান্তেই কয়েকটি লাইন
লিখে ফেললো কবি........


বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে,
তোমায় নিয়ে কবিতা লিখতে-
ইচ্ছে করছে ।
কিন্তু_
কেন যেন পারছি না ।

তোমায় নিয়ে আর-
কবিতা লিখতে পারছি না ।

তুমি মিশে আছো-
সেই বৃষ্টির মাঝে,
কিন্তু তোমায় খুজে পাচ্ছি না ।

বৃষ্টিকনা গুলো আজ
তোমার কথা বলছে না ।

লজ্জাবতীর পাতাগুলো-
তোমার কথা মনে করে
আর লজ্জা পাচ্ছে না ।

সবুজ পাতাগুলো আগের মত
তোমায় নিয়ে ঈর্ষা করছে না ।

প্রতি পাতায় তোমার প্রতিচ্ছবি-
ফুটে উঠছে না ।

বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ-
তোমার কথা বলছে না ।

বৃষ্টিধারায় নেই আজ-
সেই হাসির ঝরনা,

হয়ে গেছে অশ্রুসিক্ত চোখের-
অজস্র জলের ধারা ।

বৃষ্টি মাঝে দু'একটা পাখি-
উড়ে তোমার জন্য গান করছে না ।

কেন, জানো ??
ওরা হয়তো বুঝে গেছে-

তুমি কোনদিনও আমায়
ভালোবাসনি,,
আর কোনদিনও
ভালোবাসবে না..…....
নাহ,,,,,,


আর পারা যাচ্ছে নাহ.....!!!!!
এক অদ্ভুত রকমের কষ্ট চেপে ধরছে আস্তে আস্তে,,
নিজের অজান্তে ব্লেডটা খুলে ডান হাতে ধরে রেখেছে,,
চেয়ারটাকে ঠেলে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে জানালায় দাড়ায়
ও,,
নীলাকে অনুভব করতে চাইছে কবি,,
হঠাৎ গরম কিছু গড়িয়ে পড়ার অনুভূতি জাগে ওর হাতে,
কখন যে বাম হাতের শিরা গুলো ছিন্ন হয়ে যায় তা বুঝতেই পারে না কবি,,,,

আস্তে আস্তে দৃষ্টি শক্তিটাও যেন ক্ষীণ হয়ে আসছে,,
অনুভুতি গুলো কেমন যেন ভোতা হয়ে আসছে,,
না বলা কথার তীব্র এক আর্তনাদ হচ্ছে হৃদয় মাঝে,,,
রক্তাক্ত মেঝের উপর লুটিয়ে পড়ে কবি র নিস্তেজ
দেহটা,,,,,

রক্ত মাখা ডায়রী টা এক না বলা কথার কিছু কষ্ট
নিয়ে পড়ে আছে এক কোনায়.....

এই বৃষ্টিকণা গুলো যেন আজ শেষ বারের মতো নীলার পরশ নিয়ে কবির নিষ্পাপ দেহের উপর
আছড়ে পড়ছে একের পর এক..........





লেখা :
#_পথ_হারা_পথিক_

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন